মোবাইল যোগাযোগ (Mobile Communication)
দুটি চলনশীল ডিভাইস অথবা একটি চলনশীল ও অন্যটি স্থির ডিভাইসের মধ্যে ডেটা ও তথ্য আদান প্রদান করার লক্ষ্যে ডিজাইনকৃত সিস্টেমকে মোবাইল টেলিফোন সিস্টেম বলে। চলনশীল ডিভাইসকে মোবাইল স্টেশন (Mobile Station বা MS) অথবা মোবাইল ইউনিট বা মোবাইল সেট এবং স্থির ডিভাইসকে Land unit বলা হয়। মোবাইল সেবা প্রদানকারী বা সার্ভিস প্রোভাইডার তার আওতাধীন এলাকাকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে। প্রতিটি ভাগকে একটি সেল (Cell) বলে। এই সেল থেকেই সেলুলার ফোন নামে মোবাইল ফোনের আরেকটি নামকরণ করা হয়েছে। একটি এ্যান্টেনা এবং একটি ছোট অফিস নিয়ে একটি সেল গঠিত হয়, এ্যান্টেনাসহ ছোট অফিসকে বলে বেস স্টেশন (Base Station বা BS)। প্রতিটি বেস স্টেশন কন্ট্রোল করা হয় মোবাইল সুইচিং সেন্টার দ্বারা যেখান থেকে কল সংযোগ, কল ইনফরমেশন রেকর্ডিং, বিলিং সিস্টেম কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত হয়।
সেলুলার নেটওয়ার্কের ধারণা
সেলুলার নেটওয়ার্কে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী ব্যবহার করা হয়। সেলুলার রেডিও সিস্টেমে রেডিও সার্ভিসের সাথে ভূমি এলাকায় সিগন্যাল বা সংকেত সরবরাহ করা হয় যা নিয়মিত আকারের সেলে (Cell) বিভক্ত।
সেল ষড়ভূজাকার, বর্গাকার, বৃত্তাকার বা অন্য কোন অনিয়মিত আকারের হতে পারে, যদিও ষড়ভুজাকারই প্রথাগত বা প্রচলিত। প্রত্যেক সেলের জন্য বহু সংখ্যক ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দ রয়েছে যার সমতুল্য রেডিও বেস স্টেশন রয়েছে। এই ফ্রিকোয়েন্সিসমূহের একটি শ্রেণি পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে একই ফ্রিকোয়েন্সি প্রতিবেশী বা পাশাপাশি সেলে পুনঃব্যবহৃত না হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন ট্রান্সমিশনের জন্য বিভিন্ন এলাকায় একই রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি একটি মাত্র সাধারণ ট্রান্সমিটার থাকে তবে যে কোন প্রদেয় ফ্রিকোয়েন্সিতে কেবলমাত্র একটি ট্রান্সমিশন ব্যবহার করা যেতে পারে। একই ফ্রিকোয়েন্সি পুনরায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একটি মানসম্পন্ন FDMA সিস্টেমে বিভিন্ন সেলের মধ্যে কমপক্ষে এক সেল বিরতি অবশ্যই থাকতে হবে।
সেল সিগন্যাল এনকোডিং (Cell Signal Encoding)
এনকোডিং পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন ট্রান্সমিটার থেকে প্রেরিত সিগন্যালসমূহকে পৃথক করার প্রক্রিয়াকে সেল সিগন্যাল এনকোডিং বলে। বিভিন্ন ট্রান্সমিটার থেকে সিগন্যালসমূহকে পৃথক করতে FDMA (Frequency Division Multiple Access) এবং CDMA (Code Division Multiple Access) প্রযুক্তির উন্নয়ন করা হয়েছিল।
•FDMA এ প্রত্যেক সেলে ব্যবহৃত ট্রান্সমিটিং এবং রিসিভিং ফ্রিকুয়েন্সি (Frequency) প্রত্যেক প্রতিবেশী সেলে ব্যবহৃত ফ্রিকোয়েন্সি থেকে আলাদা। একটি সাধারণ টেক্সি পদ্ধতিতে, একটি শক্তিশালী সিগন্যাল অর্জন করতে এবং অন্য সেল থেকে আসা সিগন্যালের অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে টেক্সিচালক সেলের জন্য একটি বাছাইকৃত ফ্রিকুয়েন্সি হাতের সাহায্যে সমন্বয় করেন।
•CDMA এর মূলতত্ত্ব আরো জটিল, তবে একই ফলাফল অর্জন করে। বিতরণকৃত ট্রান্সিভার একটি সেল নির্বাচন করতে এবং এটাকে শুনতে পারে।
মোবাইল বা সেলুলার ফোন প্রযুক্তির প্রকারভেদ (Types of mobile or cellur phone technology)
বর্তমানে প্রচলিত মোবাইল ফোন প্রযুক্তিকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
১। জিএসএম (GSM-Global System for Mobile communication) প্রযুক্তি ও
২। সিডিএমএ (CDMA-Code Division Multiple Access) প্রযুক্তি।
জিএসএম (GSM)
জিএসএম (GSM-Global System for Mobile communication) ১৯৮২ সালে প্রথম নামকরণ করা হয় Group Speciale Mobile (GSM)। এর পর নামের ডেফিনেশন পরিবর্তন করে রাখা হয় Global System for Mobile Communications (GSM)। জিএসএম প্রযুক্তির তৃতীয় প্রজন্মের (Third generation) ভার্সনকে Universal Mobile Telecommunication System (UMTS) দ্বারা প্রমিতকরণ করা হয়। বাংলাদেশে গ্রামীণফোন, বাংলালিংক, টেলিটক ও এয়ারটেল জিএসএম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। জিএসএম হচ্ছে FDMA (Frequency Division Multiple Access) এবং TDMA (Time Division Multiple Access) এর সম্মিলিত একটি চ্যানেল অ্যাকসেস পদ্ধতি। FDMA এর সর্বমোট চ্যানেল সংখ্যা হচ্ছে ১২৪ এবং প্রতিটি চ্যানেল হচ্ছে ২০০ KHz। ৯৩৫-৯৬০ MHz আপলিংক (Uplink) এবং ৯৩৫-৯৬০ MHz ডাউনলিংক (Downlink) উভয়ের জন্যই ২৫ MHz বরাদ্দ থাকে। দ্বৈত পৃথকীকরণ (Duplex separation) হচ্ছে ৪৫ MHz। যদি ২০০ KHz চ্যানেলের মধ্যে TDMA ব্যবহৃত হয় তবে একটি ফ্রেমে (Frame) পরিণত হতে ৮ টাইম স্লট (Time Slot) দরকার। ফ্রেম সময়কাল হচ্ছে ৪.৬১৫ মিলিসেকেন্ড। জিএসএম সর্বপ্রথম মোবাইল রেডিও সিস্টেমের জন্য TDMA এর উন্নয়ন সাধন করে।
জিএসএম মোবাইল প্রযুক্তির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য রয়েছে-
• ইউরোপীয়ান দেশসমূহে রোমিং (Roaming) করা যায়। অন্যান্য অনেক দেশেই অর্থের বিনিময়ে এই সেবা পাওয়া যায়।
•ফ্রিকোয়েন্সি হপিং (Hopping) সুবিধা; কম ফ্রিকোয়েন্সীতে অসুবিধা হলে ফ্রিকুয়েন্সী স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়ে যায়।
•সিম (SIM) কার্ডের সহজ ব্যবহার।
•RA বক্সের মাধ্যমে ISDN এর সাথে সংযুক্ত হওয়া যায়।
•উচ্চ গুণগত মান সম্পন্ন অবিচ্ছিন্ন ট্রান্সমিশন।
•GPRS ও EDGE সুবিধা প্রদান করে। ট্রান্সমিশন পাওয়ার নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
•GSM এ মূলতঃ চার ধরনের ফ্রিকোয়েন্সি (Frequency) ব্যবহৃত হয়। এদেরকে GSM 400, GSM 900, GSM 1800, GSM 1900 দ্বারা প্রকাশ করা হয়
জিএসএম সার্ভিস (GSM Service)
জিএসএম এর প্রাথমিক সার্ভিসের লক্ষ্য হচ্ছে উঁচু মানের ডিজিটাল ভয়েস ট্রান্সমিশন নিশ্চিত করা। তাছাড়া জিএসএম এর একটি অন্যতম জনপ্রিয় সার্ভিস এর নাম হল এসএমএস (SMS বা Short Message Service) 1 রোমিং সুবিধা থাকলে পৃথিবীর যে কোন জায়গায় এসএমএস করা যায়। মেসেজ ট্রান্সফার সার্ভিসে সর্বোচ্চ ১৬০টি অক্ষর ব্যবহার করা যায়। সম্প্রতি আমাদের দেশে এমএমএস MMS (Multimedia Message Service) চালু হয়েছে। এমএমএস দ্বারা ছবি বা ইমেজ পাঠানো যায়। নিচে জিএসএম সার্ভিসের অন্যান্য বিভিন্ন সুবিধা উল্লেখ করা হলো।
জিএসএম এর সুবিধা-
• বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মোবাইল নেটওয়ার্ক যা ২১৮টি দেশে ব্যবহৃত হয়। কাজেই আর্ন্তজাতিক রোমিং সুবিধা বেশি পাওয়া যেতে পারে।
•সারা বিশ্বের গ্রাহকদের এক বিরাট অংশ জিএসএম ব্যবহারকারী বিধায় হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক, সরবরাহকারী এবং প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের জন্য বৈশ্বিকভাবে অপেক্ষাকৃত ভাল নেটওয়ার্ক ও সেবা পাওয়া সহজ হয়।
• অধিক দক্ষ এবং কার্যকর ফ্রিকোয়েন্সী। ফলে ভবনের ভিতরেও সিগন্যালের অবনতি অপেক্ষাকৃত কম হয়।
•রূপান্তরের স্পন্দন (Pulse) বৈশিষ্ট্যের কারণে জিএসএম ফোনের কথোপকোথন সময়কাল (Talktime)
•সাধারণত দীর্ঘতর হয়। সিম সহজলভ্যতার কারণে ব্যবহারকারীগণ ইচ্ছামত নেটওয়ার্ক এবং হ্যান্ডসেট বা মোবাইল সেট পরিবর্তন করতে পারেন।
•GPRS ও EDGE সুবিধা প্রদান করে।
•তৃতীয় প্রজন্মের মোবাইল টেকনোলজির উপযোগী করে ডিজাইন করা।
•নিরাপদ ডেটা এনক্রিপশন ও উচ্চমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
জিএসএম এর অসুবিধা-
•কিছু ইলেক্ট্রনিক যন্ত্র বিশেষতঃ অডিও এমপ্লিফায়ারে হস্তক্ষেপ করে ইন্টারফারেন্স তৈরি করে।
•অংশগ্রহণকারী নির্দিষ্ট কিছু শিল্প উদ্যোক্তার মাঝেই মেধা সম্পদ সীমাবদ্ধ যা নতুনদের অনুপ্রবেশে বাঁধা সৃষ্টি করছে এবং ফোন প্রস্তুতকারীদের মধ্যেকার প্রতিযোগীতা সীমাবদ্ধ করে তুলছে।
•প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে জিএসএম এ ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে সর্বোচ্চ সেল সাইট নির্দিষ্ট করা থাকে। এটা অবশ্য পূর্বে ৩৫ কিলোমিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
• বিদ্যুৎ খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি। গড়ে প্রায় ২ ওয়াট; যেখানে সিডিএমএ টেকনোলজির ক্ষেত্রে গড়ে মাত্র ২০০ মাইক্রোওয়াট।
সিডিএমএ (CDMA)
সিডিএমএ (CDMA-Code Division Multiple Access)
কোয়ালকম (Qualcom) আবিষ্কৃত সিডিএমএ (CDMA) একটি এডভান্সড ডিজিটাল ওয়্যারলেস প্রযুক্তি। ১৯৯৫ সালে এই প্রযুক্তি সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এই প্রযুক্তিতে প্রতিটি কল বা ডেটা পাঠানো হয় ইউনিক কোডিং পদ্ধতি ব্যবহার করে। এটির শুরু দ্বিতীয় প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তির মাধ্যমে। সিডিএমএ-র জন্য IS-95A স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়। সিডিএমএ ১৯৯৯ সালে তৃতীয় প্রজন্মে পা রাখে। তৃতীয় প্রজন্মে Wideband CDMA বা W. CDMA 5 MHz ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করা হয়। সিটিসেল নামক একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সিডিএমএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক চালু করে।
সিডিএমএ যে পদ্ধতিতে ডেটা আদান প্রদান করে তাকে স্প্রেড স্পেকট্রাম (Spread spectrum) বলে। এই পদ্ধতিতে ব্যবহারকারীকে একটি কোড দেওয়া হয়। এই কোড শুধুমাত্র রিসিভার প্রান্তে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। রিসিভার প্রান্তে অন্য যে কোন কোড নয়েজ হিসেবে বিবেচিত হয়। ডিজিটাল সেলুলার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সিডিএমএ সিস্টেমে পাওয়ার (Power) নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। 4
সিডিএমএ এর সুবিধাসমূহ
•ট্রান্সমিশন পাওয়ার খুবই কম। তাই কথা বলার সময় রেডিয়েশন কম হয়। একটি সাধারণ জিএসএম এবং এনালগ ফোনে ৬০০ মিলি ওয়াট থেকে ২ ওয়াট পর্যন্ত পাওয়ার প্রয়োজন হতো। অন্যদিকে, সিডিএমএ সিস্টেমে সর্বোচ্চ ২০০ মিলিওয়াট পাওয়ার দরকার হয়।
•যেহেতু সিডিএমএ সিস্টেমে কম পাওয়ার দরকার হয় সেহেতু ব্যাটারির আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পায় এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলা যায় যা পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই একে গ্রীন ফোন (Green phone)ও বলা হয়।
•এক্ষেত্রে এডভান্সড সফট সুইচিং প্রযুক্তি (Soft Switching Technology) ব্যবহৃত হয় যা সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ অংশ পরিচালনা করে এবং অন্য সুইচসমূহ অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়। প্যাকেট ডেটা সুইচিংয়ের জন্য তারা অনেক গ্রাহক পরিচালনা করতে পারে। সফট সুইচিং প্রযুক্তিতে কোন নির্দিষ্ট হার্ডওয়্যার প্রয়োজন হয় না।
•অপেক্ষাকৃত ভাল কল মান। নয়েজ (Noise) প্রায় নেই বললেই চলে। ব্যাপক নয়েজের ক্ষেত্রেও অপেক্ষাকৃত ভাল কল মান পাওয়া যায়।
•সিডিএমএ অপেক্ষাকৃত কম ব্যান্ডউইডথ ব্যবহার করে। একই ব্যান্ডউইডথে সিডিএমএ সিস্টেম জিএসএম সিস্টেম অপেক্ষা ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি ধারণক্ষম।
সিডিএমএ এর অসুবিধাসমূহ-
•আর্ন্তজাতিক রোমিং সুবিধা অপ্রতুল।
•যে কোন ধরনের মোবাইল সেট ব্যবহার করা যায় না।
•জনপ্রিয়তা ও ব্যবহার তুলনামূলক কম।
•ব্যবহারকারী বাড়ার সাথে সাথে ট্রান্সমিশনের গুণগত মান হ্রাস পায়।
•অধিকাংশ প্রযুক্তি পেটেন্ট করা; তাই মনোপলির সুযোগ রয়েছে।